মুক্ত ঝরা হাসি
-অঞ্জনা গোড়িয়া
ছেলেটি ছুটতে ছুটতে আসছে। তবু ধরা পড়ে গেল। একজন এসে হাত থেকে কেড়ে নিলো চপ মুড়ির প্যাকেট। চুরি করতে শিখেছিস এই বয়স থেকে। কি হবি বড়ো হয়ে চোর গুন্ডা মস্তান? বলেই হাত তুললো মারার জন্য। পিছন থেকে একজন ভদ্রলোক হাতটা চেপে ধরলো। এরা নিতান্তই বালক। কি বোঝে এসবের? শিশুর গায়ে হাত তুলছেন? ভদ্রলোক মাথা নিচু করে ফিরে গেল।
এখন চলছে মাধ্যমিক পরীক্ষা। সমস্ত কেন্দ্রগুলিতে অভিবভাবক, ছাত্র-ছাত্রীদের আপ্যায়নের জোর প্রস্তুতি। স্কুল গেটের বাইরে দেওয়া হচ্ছে জলের বোতল, পেন, গোলাপ ফুল,আর বিস্কুটের প্যাকেট। সঙ্গে তুলে নেওয়া হচ্ছে একটা করে ফোটো। সোস্যাল মিডিয়ায় ভিডিও বানিয়ে পোস্ট করার জন্য। সেই সঙ্গে আপ্যায়নের প্রমানপত্র হিসেবে। এক অভিনব প্রয়াস। অভিভাবকদের বসার জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা।
কোনো দিন ছোলা মুড়ি কোনো দিন চপ মুড়ি বা বাতাসা মুড়ির আয়োজন। আমরা অভিভাবকরা ভীষণ খুশি। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এমন আয়োজনের জন্য।
রাস্তার দু’পাশে খেলা করছিল কিছু বালক। পরীক্ষা চলার কারণে সকালে স্কুল হয়ে গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই সময়টা খেলার সময়। সবাই লাইন দিয়ে জলের বোতল চপ মুড়ি নিচ্ছে দেখে ছুটতে ছুটতে এসে, লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওদের দেখেই একজন বলে দিলো, দেখতে পাচ্ছো না এটা বড়োদের লাইন। তোমরা দাঁড়িয়েছ কেন লাইনে? মুখগুলো কেমন শুকনো হয়ে গেল। একজন সাহসী ছেলে বললো, বারে তাতে কি? আমাদের স্কুলের সামনে দিচ্ছো, আর আমরা পাবো না? আমরাও তো বড় হয়ে পরীক্ষা দেবো নাকি? সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। বাধ্য হয়ে মানসম্মানের খাতিরে প্রথম দিন সবাইকে একপ্যাকেট মুড়ি দেওয়া হলো। বলা হলো, কাল থেকে আর আসিস না কেমন।
অবুঝ মনের ছেলেমানুষ বালক তো ওরা। খুব মজা পেলো। পরের দিন আবার এসে লাইন দিলো। আজ কড়াকড়ি পদক্ষেপ নিলো। কর্তৃপক্ষ লাইন থেকে ওদের বের করে দিলো। বললো, এভাবে রোজ রোজ দেওয়া যাবে না। বললাম তো এটা তোমাদের জন্য নয়। পরীক্ষার্থীর মা বাবাদের জন্য। কাঁচুমাচু হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকলো ওরা।
টেবিলে সাজানো ছিল চপ মুড়ির ঠোঁঙা। ওদের মধ্যে থেকেই একটা ছেলে টেবিল থেকে একপ্যাকেট নিয়ে দৌড় দিলো।
এ সেই ছেলেটা। মুখটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যার আজ সারাদিন ভাত জোটে নি । মা অসুস্থ। তবু পেন কারখানায় কাজে গেছে। সন্ধ্যায় রান্না করবে বলেছে। খুব খিদে পেয়েছিল, তাই। বলতে বলতে ছেলেটির চোখ ছলছল করে উঠলো। মাকে বলে দিও না কাকু। আর কোনো দিন এমন করবো না। মা জানলে খুব কষ্ট পাবে।
ভদ্রলোক কাঁধে হাত রেখে বললো, এসো আমার সাথে।
প্রত্যেকের জন্য একপ্যাকেট চপ মুড়ি খাওয়ালো, সঙ্গে জিলিপি। ভদ্রলোক অবশ্য এদের সাথে সেল্ফি তুলে সোস্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন নি। তবে এরাই ফোনটা নিয়ে তাদের আদরের কাকুর সাথে সেল্ফি তুললো। নিজেদের ছবি দেখে বললো, আমাদের এক কপি করে ছবি দিতে হবে কাকু। বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো সবাই। যেন মুক্ত ঝরে পড়ছে ওদের হাসি থেকে।